পরামর্শ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। রাসুল (সা.)-কে আল্লাহ পাক নির্দেশ দিয়েছেন, আপনি বিভিন্ন বিষয়ে তাদের (সাহাবায়ে কেরামের) সঙ্গে পরামর্শ করে সম্পাদন করুন’ (আলে ইমরান : ১৫৯)। ইবনে আদি ও বায়হাকি (র.) বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে রেওয়ায়াত করেছেন, সুরা আলে ইমরানের উল্লিখিত আয়াতটি যখন নাজিল হয়, তখন রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য এই পরামর্শের কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু আল্লাহ পাক এই পরামর্শকে আমার উম্মতের জন্য রহমত ও বরকত সাব্যস্ত করেছেন’ (আনওয়ারুল কুরআন : ১/৫৪৬)।
বিশ^নবী (সা.)-কে বিশ্বনবী হওয়ার পরও যখন পরামর্শের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তা হলে আমাদের মতো সাধারণ লোকদের পরামর্শ ছাড়া কোনো উপায়ান্তর নেই। অন্য এক আয়াতে সত্যিকার মুসলমানদের গুণবৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে একটি গুণ বলা হয়েছে, (যারা সত্যিকার মুসলমান) তাদের প্রতিটি কাজ হবে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে (সুরা : ৩৮)। এ আয়াতে পরামর্শের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। এতে আমাদের প্রতি পরামর্শ সাপেক্ষ কাজে তাড়াহুড়া না করার, নিজস্ব মতকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ না করার এবং জ্ঞানী ও সুধীবর্গের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।
পরামর্শদাতার বৈশিষ্ট্য : পরামর্শের জন্য সর্বপ্রথম করণীয় হলো, যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা। পরামর্শ এমন ব্যক্তির সঙ্গে করা জরুরি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যার পূর্ণ অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তার ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহীতা ওয়াকিফহাল। এমন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করা হলে তাতে মহান আল্লাহ বরকত দান করেন এবং কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন হয়। পরামর্শদাতাকে আমানতদার হতে হবে। কেননা পরামর্শ চাওয়া মানে অন্যের কাছে বিষয়টি আমানত রাখা। আর এটা স্পষ্ট যে, আমানতের হেফাজত করা এবং তাতে কোনো প্রকার খেয়ানত না করা ফরজ। সুতরাং যার কাছে পরামর্শ চাইবে তার যদি এ ব্যাপারে জানা না থাকে তা হলে তার কর্তব্য হলো, পরামর্শ গ্রহীতাকে এ কথা বলে দেওয়া যে, আমি এ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার যোগ্য নই।
দ্বীনি বিষয়ে পরামর্শ : দ্বীনি বিষয়ে পরামর্শ করতে হলে অবশ্যই এমন মানুষের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা যার দ্বীন সম্পর্কে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং আমল ও আকিদায় কোনো ভ্রষ্টতা নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষ দ্বীনি বিষয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে অথবা জেনারেল শিক্ষিত লোকের সঙ্গে পরামর্শ করে। আর সে ব্যক্তির দ্বীনি বিষয়ে ইলম না থাকার দরুন ভুল পরামর্শ দেয়। ফলে নিজেও পথভ্রষ্ট হয় অপরকে পথভ্রষ্ট করে।
সঠিক বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া : জেনে-শুনে ভুল পরামর্শ দেওয়া মারাত্মক অন্যায় ও গুনাহের কাজ। পরামর্শ গ্রহীতার মনোরঞ্জন ও চাহিদার জন্য ভুল পরামর্শ দেওয়াও আমানতের খেয়ানতের মতো মারাত্মক অন্যায় কাজ। রাসুল (সা.) এ মর্মে ইরশাদ করেন, ‘যার কাছে তার কোনো ভাই পরামর্শ কামনা করল আর সে ভুল পরামর্শ দিল সে আমানতের খেয়ানত করল’ কুরআন-হাদিস আমাদের পরামর্শের ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয় তা সামনে রেখে আমাদের পরামর্শ চাওয়া এবং পরামর্শ প্রদান করা উচিত। এমন পরামর্শের মধ্যে আল্লাহ পাকের বরকত নিহিত রয়েছে। এর মাধ্যমে পরস্পরের মাঝে ভালোবাসা, সৌহার্দ-সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। সুদৃঢ় হয় আস্থার ভিত। দূর হয় মনোমালিন্য ও অবিশ^াস। তাই আমাদেরকে পরামর্শের প্রতিটি দিকের প্রতি লক্ষ রেখে পরামর্শ চাওয়া ও পরামর্শ প্রদান করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি কাজে আমাদেরকে তাঁর রাসুলের বাতলানো পথ অবলম্বন করার তওফিক দান করুন।
আমল কবুলে জরুরি বিষয় নেক আমল কবুল হওয়ার প্রধান শর্ত হলো ঈমান সহিহ হওয়া। যার ঈমান সহিহ নয় এবং যার মধ্যে ঈমান পরিপন্থী বিশ্বাস অর্থাৎ কুফর, শিরক ও নিফাক থাকবে তার কোনো নেক আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না এবং পরকালে তা কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের বিষয়ে কুফরি করবে তার আমল বিনষ্ট হবে এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (সুরা মায়েদা : ৫)। দ্বিতীয় শর্ত ইখলাস। যেসব নেক আমল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে করা হয় সেসব নেক আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী আমলের প্রতিদান পাবে’ (বুখারি : ১)। তৃতীয় শর্ত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত তরিকায় আমল করা। সুন্নতের বিপরীত বিদআত। যে ব্যক্তি সুন্নত তরিকা ছেড়ে নিজের মনমতো বিদআত তরিকায় আমল করবে তা আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো দ্বীনের মধ্যে নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর প্রত্যেক নব উদ্ভাবিত বিষয় বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতই পথভ্রষ্টতা। আর প্রত্যেক পথভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম।’ (মুসলিম : ১৫৩৫)
সময়ের আলো/জিকে